মোঃ আশরাফ ইকবাল পিকলু
কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি ।
মুহম্মদ আলী আহসান
অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, কুষ্টিয়া।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই মার্চ (৩রা চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দ) রাত ৮ টায় তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের বাইগার নদী তীরবর্তী টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শেখ বংশের গোড়াপত্তনকারী শেখ আউয়াল দরবেশ আল-বগদাদী সাহেবের বংশধর। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার বা হিসাব সংরক্ষণকারী ছিলেন। তার নানা শেখ আবদুল মজিদ তার নামকরণ করেন ‘‘ শেখ মুজিবুর রহমান’’। তার ছোটবেলার ডাকনাম ছিল ‘‘খোকা’’।
১৭ মার্চ জাতীয়ভাবে পালিত হয়েছে শিশু দিবস। পুরো দিনটিতে শুধু শিশুদের নিয়ে আয়োজন থাকে। শিশুদের প্রতিভার বিকাশ, শিশুদের ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে সচেতনতা বাড়াতেই দিবসটি পালিত হয়। সেই সঙ্গে শ্রদ্ধার সঙ্গে স¥রণ করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এই দিনটিতেই বঙ্গবন্ধু জন্মেছেন। শিশুদের প্রতি তার ভালোবাসা, চিন্তা-ভাবনা ছিল সীমাহীন। তাই বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটিকেই রাখা হয়েছে শিশু দিবসটি।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স¦াধীনতা অর্জনে যে ত্যাগ স¦ীকার করেছেন, তা বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু জন্মদিন ১৭ মার্চকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, শিশু হও, শিশুর মতো হও। শিশুর মতো হাসতে শেখো। দুনিয়া র ভালোবাসা পাবে- এই কথাতেই প্রমাণ মেলে বঙ্গবন্ধুর কাছে কতটা প্রিয় ছিল শিশুরা।
‘‘১৭ মার্চ ১৯৬৭। সেদিন ছিল শুক্রবার। কারাগারে বসে বঙ্গবন্ধু তাঁর দায়েরির পাতায় লিখলেন, আজ আমার ৪৭ তম জন্মবার্ষিকী। এইদিনে ১৯২০ সালে পূর্ববাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই- বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটিতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে।’’ (কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান) ১৭ মার্চ ২০২০। মঙ্গলবার। বঙ্গবন্ধু সশরীরে নেই। আছেন বাঙালির হƒদয়ের গভীরে। আছেন চেতনায়। প্রেরণায়। এগিয়ে চলার আদর্শনীতিতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাল-সবুজের এই বাংলাদেশে সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ বাঙালি।
গ্রামবাংলার একটা কথা আছে, সকালের সূর্য বলে দেয় সারা দিন কেমন যাবে। বঙ্গবন্ধুর ছোটকাল থেকে তার চারিত্রিক যে বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায় তা হলো মানবদরদী, বন্ধুপ্রীতি, ধর্মপ্রীতি, পিতামাতার বাধ্য সন্তান, উদ্ভাবনী, কর্মচঞ্চল, উদার মানসিকতা, তেজি, নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা, সাহসী, সত্যবাদী, যেকোনো স্থানে কথা বলা, বক্তৃতা দেয়ার সম্মোহনী যোগ্যতা, অপরকে সম্মানবোধ ইত্যাদি গুণ তাকে সকালের আলোকোজ্জ¦ল সূর্যের মতো করে তুলেছে। তার হাত ধরে হাজার বছরের গ্লানি মুছে যাবে। মানুষ পাবে স¦াধীনতার আনন্দ, তা ছোটকালেই প্রকাশ প্রায়।
টুঙ্গিপাড়ার নিভৃতপল্লিতে জন্ম নেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেড়ে ওঠা যেমন বর্ণিল, তেমনি চমকপ্রদ। ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্ম নেওয়া খোকা ছোটবেলায় ছিলেন দুরন্ত বালক। গ্রামের কাদা-জল, মেটোপথ আর প্রকৃতির খোলামেলা পরিবেশে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু শৈশব থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মানবদরদি কিন্তু অধিকার আদায়ে আপসহীন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং তার কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা শেখ মুজিব আমার পিতা গ্রন্থসহ বিভিন্ন লেখকের গবেষকদের লেখনীতে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে সবার আদর পাওয়ার বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘‘ আব্বার কাছে থেকেই আমি লেখাপড়া করি। আব্বার কাছেই আমি ঘুমাতাম। তাঁর গলা ধরে রাতে না ঘুমালে আমার ঘুম আসতো না। আমি বংশের বড় ছেলে তাই সমস্ত আদর আমারই ছিল।’’
কন্যা শেখ হাসিনার এক লেখায় জাতির পিতা এভাবে উঠে এসেছেন, আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠোপথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙা কীভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা, দোয়েল পাখির সুমধুর সুর আমার আব্বাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করতো। আর তাই গ্রামের ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে করে মাঠে-ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সাথে মিশে বেড়াতে তাঁর ভালো লাগতো। ছোট্ট শালিক পাখির ছানা, ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা ও শিস দেওয়া শেখাতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন, তারা তার কথামতো যা বলতেন তাই করতো। এই পোষা পাখি জীবজন্তুর প্রতি এতটুকু অবহেলা তিনি সইতে পারতেন না।
খেলাধুলা পাখি ধরা, মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানো সত্বেও তিনি সে সময় বাড়িতে খুব পড়াশোনাও করতেন। বিশেষ করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা তিনি নিয়মিতই পড়তেন। বাড়িতে বাবা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত। এসবই সে সময়ের জনপ্রিয় পত্রিকা। সে সময়ের শিক্ষিত পরিবার মাত্রই এসব পত্রিকা বাড়িতে রাখতেন। ছোটবেলা থেকে এসব পত্রিকার সঙ্গে পরিচয় থাকার কারণে ছোট্ট মুজিবের সামনে বিপুলা পৃথিবীর এক দরাজ দরজা খুলে গিয়েছিল।
কিশোর বয়সে বঙ্গবন্ধু খেলাধুলার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি খেলাধুলাও করতাম। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতাম। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম না। তবু স্কুলের টিমের মধ্যে ভালো অবস্থান ছিল। এই সময় আমার রাজনীতির খেয়াল তত ছিল না।’
যে বয়সটা দুরন্তপনার, সে সময়ে সংসার জীবনে পা রাখতে হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে মুরুব্বির হুকুম মানার জন্য তিনি ১২/১৩ বছর বয়সে রেনুকে (৩ বছর) (বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে) বিয়ে করেন।
ছেলে বেলাতে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাক্ষাত তাঁর সারা জীবনের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ,কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে এলে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয় তাঁর নেতৃত্বে। সেখানেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে আলাপ হয়। ঐ আলাপের পরে শেখ মুজিবের নাম-ঠিকানা লিখে নেয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তারপর চলে তাদের মধ্যে পত্র যোগাযোগ। আর এভাবেই গড়ে ওঠে বাঙালির রাজনৈতিক মঞ্চে গণতন্ত্রের সংগ্রামে গুরু-শিষ্যের এক অনন্য যুগলবন্দি। এটাই তাঁর পুরো রাজনৈতিক জীবনের খুব বড় একটা ট্রার্নিং পয়েন্ট।
একবার যুক্তবাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা গোপালগঞ্জ সফরে যান এবং স্কুল পরিদর্শন করেন। সেই সময় সাহসী কিশোর শেখ মুজিব তাঁর কাছে স্কুলঘরে বর্ষার পানি পড়ার অভিযোগ তুলে ধরেন এবং মেরামত করার অঙ্গীকার আদায় করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
শেখ হাসিনা লিখেছেন তখনকার দিনে ছেলেরা তেমন পড়াশোনার তেমন সুযোগ ছিল না। অনেকে বিভিন্ন বাড়ীতে জায়গীর থেকে পড়াশোনা করতো। চার-পাঁচ মাইল হেঁটে স্কুলে আসতে হতো। সকালে ভাত খেয়ে স্কুলে আসতো। আর সারা দিন অভুক্ত অবস্থায় অনেক দূরে হেঁটে তাদের ফিরতে হতো। ফিরে শেখ মুজিবুর রহমান সকল সহপাঠিদের নিয়েই দুধ-ভাত খেতেন। তিনি গরীব ছাত্রদের মধ্যে ছাতা এবং বই বিতরন করতেন। যখন ছুটির সময় হতো তখন শেখ মুজিবুরের মাতা আম গাছের নিচে এসে দাঁড়াতেন। একটি দিন দেখেন তাঁর খোকা গায়ে চাঁদর জড়িয়ে হেটে আসছে গায়ে পায়জামা-পাঞ্জাবী নেই। এক গরীব ছেলেকে তার শতছিন্ন কাপড় দেখে সব দিয়ে এসেছে।
একবার তাঁর গ্রামের চাষিদের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সারা গ্রামে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করে। নিজের পিতাকে তিনি তাদের গোলা থেকে বিপন্ন কৃষকদের মধ্যে ধান বিতরণের জন্য অনুরো জানালেন। বঙ্গবন্ধুর গৃহশিক্ষক ছিলেন আবদুল হামিদ। তিনি গোপালগঞ্জে একটা মুসলিম সেবা সমিতি গঠন করেন যার দ্বারা গরীব ছেলেদের সাহায্য করতেন। বঙ্গবন্ধু তার সহযোগী হিসেবে এসব কাজে যুক্ত ছিলেন। প্রত্যেক রবিবার তারা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাল উঠিয়ে আনতেন এবং এই চাল বিক্রি করে গরীব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষা ও অন্যান্য খরচ দিতেন। জায়গীরও ঠিক দিতেন। হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে গৃহশিক্ষক মারা গেলে বঙ্গবন্ধু নিজেই সেবা সমিতির ভার নেন এবং ওই সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অনেক দিন পরিচালনা করেন।
বঙ্গবন্ধু নিজের কোন সুবিধা আদায়ের জন্য কখনও সংগ্রাম করেননি, তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন সাধারণ জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য। বঙ্গবন্ধুর ২৩ বছর রাজনৈতিক জীবনে মোট ৩০৫৩ দিন জেল খেটেছেন। জনস¦ার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো তাকে কারাভোগ করতে হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের এক সহপাঠী আব্দুল মালেককে হিন্দু মহাসভা সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে ধরে নিয়ে মারধর করা হয়। উক্ত খবর পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান দলবল নিয়ে তথায় গমন করেন এবং তুমুল মারামারির একপর্যায়ে দরজা ভেঙ্গে মালেককে বের করেন। উক্ত ঘটনার কারণে মামলা হয় এবং তিনি ১০ দিন হাজত খেটে ১৫০০/- টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে হাজত থেকে বের হন। এটাই ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের প্রথম জেল।
বঙ্গবন্ধু সব শিশুর অধিকার নিশ্চিতে কাজ করতেন। এজন্য স¦াধীনতা পরবর্তী তিনি দেশে যেসব যুদ্ধশিশু জন্ম নিয়েছিল তাদেরসহ বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনে বঙ্গবন্ধু গঠন করেন বাংলাদেশ পুনর্বাসন বোর্ড। ঢাকার ধানমন্ডিতে যে পুনর্বাসন কেন্দ্রটি ছিল তা পরিচালনা করতেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ১৯৭২ সালজুড়ে অনেক যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়। বঙ্গবন্ধু সরকার এ সময় বিশ্বের নানা দেশে যুদ্ধশিশুদের দত্তকের ব্যবস্থা করেন। এর জন্য ১৯৭২ সালে তিনি একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন।
শিশুরাই আগামী প্রজন্ম। তারা গড়ে উঠুক কল্যাণকামী ও সৌন্দর্যমূলক জীবনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে। এই স¦প্ন আমাদের চেতনায় জাগিয়ে দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর কাছে তাঁর শিশুপুত্র রাসেল ছিল বাংলাদেশের সব শিশুদের প্রতীক। তিনি অনুধাবন করেছেন শিশুর কাছে জাত-পাত, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই। স¦াধীন বাংলাদেশকে গড়তে হলে শিশুদের গড়তে হবে। ওদের ভেতরে দেশপ্রেম জাগাতে হবে। এ লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে শিশুসহ সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার দেয়া হয়েছে। সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে সকল নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে শিশুদের অগ্রগতির বিষয়ে বিধান প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে শিশুদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাসহ মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, সুযোগের সমতা, অধিকার ও কর্তব্য এবং জনস¦াস্থ্য ও নৈতিকতা বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শিশু উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শিশুদের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে ১৯৭৪-এর ২২ জুন শিশু আইন প্রণয়ন করেন। এর ১৫ বছর পর জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ তৈরি করে।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু গ্রন্থের সমাজের হাতে ও রাষ্ট্রের হাতে প্রাথমিক শিক্ষা প্রবদ্ধে লেখা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঞযব চৎরসধৎু ঝপযড়ড়ষং (ঞধশরহম ঙাবৎ) অপঃ প্রণয়ন করেন। ওই সময়ই প্রাথমিক শিক্ষরা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়। প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৮ বছর করার প্রস্তা ব দেওয়া হয়। গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনামুল্যে বই, অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ ও খাবার বিতরণ করার সিদ্ধান্ত নেন। মেধাবীদের বিনামূল্যে পোশাকও দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
স¦াধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শিশুদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অনেক গুরুত্ব দেন। তিনি রাষ্ট্রপ্রতি ও প্রধানমন্ত্রী হয়েও স¦াধীনতার পর কচিকাঁচার মেলার অনুষ্ঠানগুলোতে আসতেন। উনি যখন দ্বিতীয় বিপ্লবের জন্য বাকশাল করলেন, তখন মেলা ও খেলাঘরকে একত্রিত করে দুটিকে সরকারি শিশু প্রতিষ্ঠান করা হয়। শিশুদের দিকে কতটা নজর ছিল যে, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বা বাকশাল ঘোষণার সময় এই দুটি প্রতিষ্ঠান যেহেতু প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক তাদের দিয়ে তিনি জাতীয় শিশু সংগঠন গড়ে দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন শিশুদের প্রিয়বন্ধু। বড়োদের মতো শিশু-কিশোরদের কাছেও তিনি ছিলেন ‘মুজিব ভাই’। ১৯৬৩ সালের কথা। ঢাকা প্রেস ক্লাবে আয়োজন করা হয় দশ দিনব্যাপী শিশুমেলা। ওই শিশুমেলায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই পবিত্র শিশুদের সঙ্গে মিশি মনটাকে একটু হালকা করার জন্য।’ নিজের শৈশবকালটা বর্ণাঢ্য করেছিলেন মানুষকে ভালবাসার মধ্য দিয়ে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অধিকার সচেতন। নিজের স্কুলের সমস্য সমাধানে নেতৃত্বে দিয়েছেন। দাবি আদায় করেছেন। দুঃখীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বন্ধুকে ছাতা দিয়ে নিজের বাড়ি ফিরেছেন দৃষ্টিতে ভিজে ভিজে। শীতকালে গায়ের চাদর খুলে দিয়েছেন বৃদ্ধকে। বেড়ে উঠেছেন মানবিক গুণাবলি নিয়ে। তাঁর অন্তর ছিল মমতামাখা। তাঁর আন্তরিক ভালোবাসায় দেশের শিশু সংগঠনগুলো হয়েছে বর্ণিল। কচিকাঁচার মেলার মার্চপাষ্টে সালাম গ্রহণ করেছেন। খেলাঘরের ভাই-বোনদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। শিশুদের সঙ্গে তিনি সব সময় থাকতেন হাস্যোজ্জ¦ল। শিশুদের জন্য বঙ্গবন্ধুর দুয়ার ছিল খোলা। ১৯৭২-এর মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় সফরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়েছিলেন। সে সময়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরামর্শে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকারদের অত্যাচারের দৃশ্য নিয়ে ৫ থেকে ১২ বছরের ১৫-১৬ জন শিশুর আঁকা ছবি সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভকে উপহার হিসেবে দেওয়ার জন্য গণভবন ‘সুগন্ধায়’ যান। শিশুদের আঁকা ছবিগুলি বঙ্গবন্ধুর হাতে তলে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেন, আমার দেশের শিশুরা এমন নিখুঁত ছবি আঁকতে পারে, এসব না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আজকের কর্মব্যস্ত সারাটা দিনের মধ্যে এই একটু খানি সময়ের জন্য আমি শান্তি পেলাম। শিশুদের সান্নিধ্য আমাকে সব অবসাদ থেকে মুক্তি দিয়েছে।
অন্য একটি ঘটনা। ১৯৭২-এর এক সকালে বঙ্গবন্ধু হাঁটতে বেরিয়েছেন, যেমনটি রোজ বের হন। সঙ্গে বড় ছেলে শেখ কামাল। তিনি হঠাৎ দেখলেন একটি ছোট ছেলে বইয়ের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। কাছে ডাকার পর ছেলেটি জানায় যে, তার পা ব্যথা করছে বলে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বঙ্গবন্ধু নিজে ছেলেটির জুতা খুলে দেখেন যে, জুতার মধ্যে একটা পেরেকের সুঁচালো মাথা বেরিয়ে আছে, যার খোঁচায় ছেলেটির পা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তখনই চিকিৎসার জন্য তাঁর দেহ রক্ষী পুলিশকে নির্দেশ দিলেন, তার হাতে কিছু টাকাও দিলেন। আর পরম মমতায় ছেলেটিকে কোলে নিয়ে আদর করলেন। (সূত্র ঃ ডিটেকটিভ, মার্চ ২০১৯ সংখ্যা) শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অপরিসীম দরদ। তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজ, মানুষ আর মানুষের রাজনীতির মধ্যে যত বিভেদই তৈরি হোক না কেন, প্রতিটি শিশুকে সাম্য ও সমতার মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠতে হবে। শিশুদের প্রাণে জাগাতে হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। সকল প্রকার অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে দূরে ঠেলে নতুন থেকে নতুনের দিকে এগিয়ে চলার যে শিক্ষা শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়ক, সেই শিক্ষাই ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন শিশুর অন্তরে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী ইতিহাস ও বাঙালির বর্ণিল ঐতিহ্যের সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার অর্থই হলো ভবিষ্যতের জন্য গৌরবময় পথ তৈরী করে দেয়া। আমরা সে পথ করে দিতে চাই। যেখানে থাকবে পারিবারিক শ্রদ্ধাবোধ, বন্ধুত্বময় পরিবেশ, একে-অপরের প্রতি সহমর্মিতা, মানবিক গুনা বলি সম্পন্ন আচরণ এবং অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক শিক্ষা। এসবের মধ্য দিয়েই আজকের শিশুরা একদিন সাম্য ও সমতার বিশ্ব নির্মাণে হয়ে উঠবে আগামী দিনের নেতৃত¦দানকারী। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার অন্যতম শক্তি আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম; যারা আজকের শিশু-কিশোর। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্র্রদায়িক সমাজ নির্মাণ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকারের যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলছেন, সেই বাংলাদেশের আগামী নেতৃত্ব আজকের শিশু-কিশোরদের কাছে দেশপ্রেম, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, সততা, নিষ্ঠা, তথ্যপ্রযুক্তি, বিজ্ঞান এবং সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্তিত পরিপূর্ণ জ্ঞান আহরণের মধ্য দিয়ে আজকের শিশু-কিশোরদের চিনতে হবে বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুকে চেনা মানেই বাংলাদেশকে চেনা। আগামী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে আজকের শিশু-কিশোরদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে লালন করতে হবে। সত্যকে জানতে হবে। মানবিক হতে হবে। উদার হতে হবে। এসব গুণাবলি অর্জনের মধ্য দিয়ে দেশকে ভালোবাসতে হবে। বড়োদের কাছ থেকেই শিশুরা নৈতিকতার শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
আজকের দিনে বঙ্গবন্ধুর স¦প্নের মতো খুব সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ দিনের কথা কল্পনা করে আসা যাক। যদি এমন হতো, একদিন আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে প্রতিটা বাচ্চা হাসিমুখে স্কুলে যাচ্ছে? শুধু পাস করার জন্য নয় বরং শেখার আনন্দ নিয়ে বাচ্চারা স্কুলে পড়াশোনা করছে? বিজ্ঞানের প্রতিটা মজার মজার এক্সপেরিমেন্ট হাতে কলমে করছে?
এ কল্পনার জগতে ঘরে আসতে নিশ্চয় সবারই ভাল লেগেছে খুব। কিন্তু স¦প্ন আর বাস্তবতার মাঝে এখনো অনেক ফারাক। এই দেশের বিশাল জনগোষ্ঠিতে শিশুরা এখনো খুব অবহেলিত একটা পরিবেশে বড় হচ্ছে। শিক্ষার হার তুলনামুলক বাড়লেও এখনো অনেক শিশুই তাদের প্রকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আছে শিশু শ্রমের মতো প্রকট কিছু সমস্যাও।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী, এবং শৈশব থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদী। তিনি যেমন নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে অগ্রগামী ছিলেন, তেমনি অন্যের দুঃখ-দুর্দশায় সবার আগে পাশে দাঁড়াতেন। আজকালকার শিশু-কিশোরদের মাঝে এই শুণাবলীগুলো খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। শিশুদের মাঝে অনেকেই অন্যায় কার্যক্রমে যেমন জড়িয়ে পড়ছে, ঠিক তেমনি অনেকে আবার অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পিছপা হচ্ছে। আজকের শিশু- কিশোররা ক্ষেত্রবিশেষে আত্মকেন্দ্রিক হওয়া শিখছে। তারা অনেকেই অন্যের উপকার করতে কিংবা সমাজের উন্নয়নের নিচু শ্রেণীর মানুষকে সাথে নিয়ে কিভাবে সুন্দর সমাজ তৈরি করতে হয় সে বিষয়গুলো শিখছে না। দুটি প্রবাদ বাক্যের কথা সবাইকে স¥রণ করিয়ে দিতে চাই, আজকের শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ এবং ‘যার নয়ে হয়না তার নব্বুইয়েও হয়না’। অর্থাৎ আজকের শিশুকে আমরা যেভাবে তৈরি করব, তারা বড় হয়ে দেশটাকে সেভাবেই পরিচালনা করবে। শিশু-কিশোররা বেড়ে উঠুক সুন্দর ও সঠিকভাবে। শিশুদের শৈশব বঙ্গবন্ধুর আদর্শে পরিপূর্ণ হলে, তবেই তো তারা হবে সোনার বাংলার উপযুক্ত কর্ণধার।
আমেরিকার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জেমস বান্ডউইন বলেছেন, ‘ বড়দের কথা শোনার ক্ষেত্রে শিশুরা খুব দক্ষ নয়, তবে বড়দের অনুসরণ করার ক্ষেত্রে তারা কখনো ব্যর্থ হয় না।’ তাই শিশুদের নৈতিকতা শেখানোর সব থেকে কার্যকরী উপায় হলো, বড়দের নৈতিকতা চর্চা করা। শিশুরা কাদা মাটির মত; আমরা যেভাবে চাইবো, তাদের সেভাবে গড়ে তুলতে পারবো। তাই শিশুদের সামাজিকীকরণে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আমাদের কর্মকান্ড। আজকের শিশুরাই আগামীর কর্ণধার। তাই তাদের সেভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেভাবে করলে তারা যোগ্যতার সাথে আগামীতে দেশকে নেতৃত্ব দিতে পারবে। শিশুরা কি চিন্তা করবে তা নয়। বরং কিভাবে চিন্তা করবে আমাদের তা শিখিয়ে দিতে হবে।
আসুন আমরা শিশুদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করি। আমাদের বর্তমানকে তাদের জন্য উৎসর্গ করি। তাদের জন্য এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলি যে দেশ হবে ক্ষুধা, দারিদ্র, নিরক্ষতামুক্ত জাতির পিতার স¦প্নের সোনার বাংলাদেশ।
তথ্যসূত্র ঃ
১। অসমাপ্ত আত্মজীবনী- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান;
২। শেখ মুজিবুর রহমান- উইকিপিডিয়া;
৩। কেমন ছিল বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলা- এমরান হোসাইন শেখ;
৪। শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালবাসা- ভোরের কাগজ।