নুরুল কবির সাতকানিয়া প্রতিনিধি চট্টগ্রাম
ভারত মহাসাগরে জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি করা সোমালিয়ার জলদস্যুদের কোনো ফোন কল আসেনি, মুক্তিপণও দাবি করা হয়নি। শুক্রবার ছুটির দিনও শনিবার এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এসআর শিপিং অফিসে কয়েকজন কর্মকর্তা–কর্মচারীর একটি টিম দস্যুদের ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত দস্যুদের সাড়া নেই। অপরদিকে জাহাজের নাবিকদের কাছ থেকেও বিশেষ কোনো ফোন আসেনি। নাবিকেরা জাহাজ থেকে স্যাটেলাইট ফোনে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। নাবিকদের সকলে ভালো আছেন এবং নিজেদের কাজকর্ম করতে পারছেন বলে তাদের স্বজনরা জানিয়েছেন। কিন্তু তারা কেউ সরাসরি অফিসে যোগাযোগ করতে পারছে না। স্বজনরাই বিভিন্ন সময় অফিসে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতেছে।
এদিকে জিম্মি হওয়া জাহাজটির উপর নজরদারি অব্যাহত রেখেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স–ইইউএনএভিএফওআর। ‘অপারেশন আটলান্টা’ হিসেবে পরিচালিত এ কার্যক্রম সম্পর্কে সংস্থাটি বৃহস্পতিবার গভীর রাতে তাদের এক্স অ্যাকাউন্টে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অপারেশন আটলান্টা বাংলাদেশি পতাকাবাহী পণ্যবাহী বাণিজ্যিক জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর জলদস্যুতার শিকার হওয়ার ঘটনাটি এখনো অনুসরণ করছে। ছিনিয়ে নেওয়ার সময় এমভি আবদুল্লাহতে ২০ জন সশস্ত্র জলদস্যুর উপস্থিতি থাকলেও এখন জাহাজটিতে ১২ জন দস্যু আছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
নাবিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে স্থানীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, সোমালিয়ার স্থানীয় সরকারের নির্দেশক্রমে এমভি আবদুল্লাহ শুক্রবার সকাল ১১টায় নোঙর তুলে স্থান পরিবর্তন করেছে। বিকাল ৪টার দিকে আগের অবস্থান হতে ৪০ মাইল দূরে এসে নোঙর করেছে জাহাজটি। একটি সূত্র বলেছে, জাহাজটির অবস্থান সম্পর্কে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং চিফ ইঞ্জিনিয়ার জলদস্যুদের সঙ্গে দোভাষীর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আলাপ সারছেন। ইশারায় টুকটাক কথাবার্তা চলছে দস্যুদের সঙ্গে। তবে তাদের দাবি বা জাহাজ মুক্তির ব্যাপারে কোনো কথা হয়নি।
জলদস্যুরা নাবিকদের বাসস্থান বা একোমোডেশন নিয়ে হস্তক্ষেপ করেনি। তবে তাদের নেতাগোছের ২–৩ জন দস্যু পাইলটের কেবিন দখল করে সেখানে অবস্থান করছে। বাকি দস্যুরা রাতে ব্রিজ উইংয়ে বা ব্রিজের দুই পাশের খোলা ডেকে অবস্থান করছে। নাবিকরা জাহাজের স্টোর রুম হতে চাদর, বালিশ ইত্যাদি দস্যুদের সরবরাহ করেছে। জাহাজের সিকিউরিটিসহ পুরো নিয়ন্ত্রণ দস্যুদের হাতে। তারা জাহাজের বিভিন্ন পয়েন্টে মেশিনগান আর একে–৪৭ রাইফেলসহ অবস্থান করছে।
নাবিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে চট্টগ্রামে অবস্থানকারী ক্যাপ্টেন আতিক খান বলেন, জলদস্যুরা দিনের বেলা সব নাবিককে ব্রিজে থাকা স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে। তবে সন্ধ্যার পর ফোন ব্যবহার করতে দিচ্ছে না। জলদস্যুরা নাবিকদের স্থানীয় সিমকার্ড এনে দেবে বলে আশ্বস্ত করেছে।
তিনি জানান, শুক্রবার থেকে দস্যুরা নাবিকদের জাহাজের সাধারণ রুটিন মেনে চলার জন্য অনুমতি দিয়েছে। জাহাজটির ইঞ্জিনিয়াররা ইঞ্জিন রুমে স্বাভাবিক কাজকর্ম করছেন। ইঞ্জিনরুমে দস্যুদের কোনো পাহারা নেই। ডেক অফিসাররাও কার্গো হোল্ডের ৫৫ হাজার টন কয়লার তাপমাত্রা নিয়ে কাজ করছেন; যাতে কয়লার তাপমাত্রা আর হোল্ডের অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এটি নিয়ন্ত্রণ না করলে কয়লায় বিস্ফোরণ ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি আরো জানান, শুক্রবার নতুন করে আরো ১০–১২ জন জলদস্যু জাহাজে যুক্ত হয়েছে। ২৫–৩০ জন জলদস্যু সবসময় জাহাজে অবস্থান করছে। জাহাজে ১০–১২ দিনের খাবার মজুদ রয়েছে। এরপর সোমালিরা প্রতিদিন খাসি জাতীয় প্রাণী জবাই করে সবাই মিলে খাবে। তবে পানি ফুরিয়ে গেলে কী হবে তা নিয়ে নাবিকেরা দুঃচিন্তায় রয়েছেন। তবে নাবিকরা কোনো বিষয় নিয়ে দস্যুদের সঙ্গে তর্কে যাচ্ছেন না। দস্যুরা যা বলছে নাবিকরা তা করছেন, শুনছেন। জলদস্যুরাও গতকাল পর্যন্ত কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স বা ইইউএনএভিএফওআরের বিবৃতিতে আরো বলা হয়, কিছুদিন আগে ওই অঞ্চলে এমভি রুয়েন নামে একটি জাহাজ জলদস্যুতার শিকার হয়েছিল। ওই জাহাজটি যারা ছিনিয়ে নিয়েছিল সেই একই গ্রুপ এমভি আবদুল্লাহর ঘটনায় জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সোমালিয়া উপকূলের উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্য অঞ্চলে সোমালিয়ার জলদস্যুদের তিনটি সম্ভাব্য ক্যাম্প চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব ক্যাম্প থেকেই জলদস্যুরা জাহাজ ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযানে সহায়তা করে। ‘অপারেশন আটলান্টা’ এমভি আবদুল্লাহকে ঘিরে তাদের কার্যক্রম এখনো চলছে উল্লেখ করে জানায়, ছিনতাই হওয়া জাহাজের পরিস্থিতি এখনো একই রকম আছে। জাহাজের নাবিকরা নিরাপদে আছেন।
কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অপারেশন আটলান্টা বাংলাদেশ ও সোমালি কর্তৃপক্ষ এবং ওই অঞ্চলের সমুদ্র নিরাপত্তায় কাজ করা অংশীদারদের সাথে যোগাযোগ রাখছে বলে সর্বশেষ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
এদিকে এমভি আবদুল্লাহর চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান তার ছোট ভাইকে পাঠানো এক অডিও বার্তায় বলেছেন, দুটি নেভি জাহাজ আবদুল্লাহকে অনুসরণ করছে। তিনি বলেন, গত বুধবার একটা নেভি জাহাজ আসছিল। বৃহস্পতিবার একটা এসেছে। টোটাল দুইটা এসে আমাদের রেসকিউ করতে চাইছিল। বাট পসিবল না, কারণ ওরা তখন আমাদের মাথায় গান ধরে জিম্মি করে রাখে। নেভি জাহাজ ফ্রিগেট আসলে তারা আমদের জিম্মি করে। বৃহস্পতিবার বিকালে আতিক ছোট ভাইকে বার্তাটি পাঠিয়েছিলেন।
গতকাল পর্যন্ত দস্যুদের কোনো ফোন আসেনি বা কোনো মুক্তিপণ দাবি করা হয়নি বলে জানিয়েছেন কেএসআরএম গ্রুপের উপ–ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহরিয়ার জাহান। তিনি বলেন, আমরা ফোন কলের অপেক্ষা করছি। কিন্তু তারা চুপচাপ। আমরা বিকল্পভাবেও যোগাযোগের চেষ্টা করছি। ২৩ নাবিকের জীবন আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তাদেরকে সুস্থভাবে ফিরিয়ে আনার জন্য সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
তিনি বলেন, জাহাজের নাবিকরা ভালো আছেন, সুস্থ আছেন। জলদস্যুরা নাবিকদের কোনো ক্ষতি করেনি। এটাই আমাদের কাছে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় খবর। নাবিকদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় আমরা সেই চেষ্টা করছি।