মোঃ আশরাফ ইকবাল পিকলু মাজমাদার
কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি।
গণ অভ্যুত্থানের চেতনায় শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় সমাজতন্ত্রের লড়াই বেগবান।
বাসদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও রুশ বিপ্লব বার্ষিকী উপলক্ষে সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
শনিবার (৩০ নভেম্বর) বিকেল ৫টার সময় কুষ্টিয়া পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে সভাপতি কমরেড শফিউর রহমান শফি, আহ্বায়ক কুষ্টিয়া জেলা কমিটির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত সভায় বক্তব্য রাখেন কমরেড নিখিল দাস, সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি। আরো বক্তব্য রাখেন কমরেড প্রকৌশলী শম্পা বসু, সদস্য বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটি। কমরেড আশরাফুল ইসলাম, সদস্য সচিব, বাসদ কুষ্টিয়া জেলা কমিটি ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সভায় বক্তারা বলেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এর ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও মহান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ১০৭তম বার্ষিকীর শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
একটি শোষণ-বৈষম্যহীন ও মর্যাদাপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সামরিক, বেসামরিক স্বৈরাচার, দেশি-বিদেশি লুণ্ঠন প্রতিরোধ ও শ্রমিক-কৃষক, নারী ও ছাত্রসমাজের দাবি আদায় এবং শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য বাসদ-এর নেতাকর্মীরা আপসহীন লড়াই অব্যাহত রেখেছে।
শোষণ থেকে মুক্তির আশায় জনগণ লড়াই করছে বারবার দারিদ্র্য-বৈষম্যের বিরুদ্ধে এই ভূখণ্ডের মানুষের লড়াই দীর্ঘদিনের। ব্রিটিশ তাড়িয়ে পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে মানুষ লড়েছিল মুক্তির আশায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার ছিল।
৩০ লাখ মানুষের জীবনদান, ২ লাখ মা-বোনের লাঞ্চনা, কোটি মানুষের দেশত্যাগ আর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনবাজি রেখে লড়াইয়ের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার আর এদেশীয় সাম্প্রদায়িক শক্তি ও তাদের দোসরদের পরাজিত করে দেশ স্বাধীন হয়েছিল।
কিন্তু দেশ স্বাধীন হলেও মানুষের মুক্তি আসেনি। তাই লড়াইও শেষ হয়নি। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ১৯৯০ সালের সামরিক শাসন বিরোধী গণ অভ্যুত্থান এবং ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-শ্রমিক জনতার অভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের অপূরিত স্বপ্নকেই আবারও তুলে ধরেছে।
জনগণ লড়াই করে আর শোষকশ্রেণি বিজয় ছিনতাই করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি প্রায় উপনিবেশিক শাসক-শোষকদের জনগণ পরাজিত করেছিল কিন্তু সচেতন সংগঠিত নেতৃত্বের অভাবে শোষিতশ্রেণি বিজয় ধরে রাখতে পারে নাই।
ক্ষমতায় এসেছে বুর্জোয়াশ্রেণি ও তার সহযোগীরা। এরা দুর্নীতি ও লুটপাট করে দেশের সম্পদ পাচার করেছে, মেগা প্রকল্পের নামে বিদেশি ঋণের জালে দেশকে বেঁধে ফেলেছে, নিবর্তনমূলক কালোআইনে জনগণের কণ্ঠ রুদ্ধ করেছে, ব্যবসায়ী তোষণ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের জীবনযন্ত্রণা বাড়িয়েছে, ন্যায্য মজুরি থেকে শ্রমিক এবং ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে কৃষককে বঞ্চিত করেছে।
মাদকের নেশায় যুবসমাজকে যেমন আচ্ছন্ন করেছে, তেমনি ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার স্বার্থে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে শক্তিশালী করে মানুষের যুক্তিবাদী মনকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়েছে।
নির্বাচনকে ভোট ডাকাতি ও টাকার খেলায় পর্যবসিত করেছে আর সংসদকে বানিয়েছে ব্যবসায়ীদের বিনোদন ও ব্যবসার ভাগ বাটোয়ারার প্রতিষ্ঠানে। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে সংবিধানকে সংশোধন করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সংকুচিত করেছে। এরা শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে মুনাফার পণ্যে পরিণত করেছে, বেকারত্ব দূর না করে সন্তায় শ্রমিক পাওয়ার ব্যবস্থা চালু রেখেছে। শ্রমিক-কৃষক দেশে সম্পদ তৈরি করে, প্রবাসীরা কষ্ট করে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠায় আর শোষকশ্রেণি লুটপাট করে বিদেশে অর্থ পাচার করে।
গত ৫২ বছরে বুর্জোয়াদের শাসনে এই লুণ্ঠন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। শোষণের কারণ পুঁজিবাদ, শোষণের ফলাফল দারিদ্র্য ও বৈষম্য পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা শ্রমিক এই দেশে অথচ দ্রুত গতিতে ধনী হওয়ার তালিকার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। সরকারি হিসাবে মাথাপিছু আয় ও জিডিপি বাড়ছে কিন্তু জনগণ দেখে যে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।
ব্যয়বহুল স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল বাড়ছে অথচ সরকারি হাসপাতালে ভিড় করে থাকা সাধারণ মানুষ ন্যূনতম চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না, টাকার অভাবে সন্তানের লেখাপড়া করাতে পারছে না।
এই বৈষম্যকে কপাল বলে মনে করার কারণ নেই। বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে শোষণমূলক পুঁজিবাদের পথে দেশ পরিচালনা করার কারণে। মুক্তির পথ সমাজতন্ত্র। আসুন শোষণ মুক্তির লড়াই শক্তিশালী করি সারা পৃথিবীর মানুষ শত শত বছর ধরে লড়ছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে।
এক শাসকের পরিবর্তে আরেক শাসক এসেছে কিন্তু দুঃখ ও বৈষম্যের অবসান হয় নাই।
কার্ল মার্কস দেখিয়েছেন কীভাবে শ্রমজীবীর শ্রমের ফল আত্মসাৎ করে পুঁজিপতিদের সম্পদ বাড়ে।
শোষণের যেমন নিয়ম আছে শোষণহীন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠারও তেমনি নিয়ম আছে।
সেই নিয়মকে কাজে লাগিয়ে ১৯১৭ সালে লেনিন রাশিয়াতে বিপ্লব করে দুনিয়ার বুকে প্রথম শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
তার পর ১৫ বছরের মধ্যেই কমরেড স্তালিন দেখিয়েছিলেন কীভাবে সমাজ থেকে বেকারত্ব, ভিক্ষাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তি দূর করা যায়।
এই শিক্ষাকে ধারণ করে বিশ্বের দেশে দেশে মানুষ তাই লড়ছে শোষণমুক্তির আশায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ আহ্বান জানায় আসুন ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, ‘৯০ এর গণ অভ্যুত্থান ও ২০২৪ এর গণ অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বিজয়ী করি।
এই লড়াইয়ে আপনাদের সমর্থন-সহযোগিতা, অংশগ্রহণ মুক্তির সংগ্রামকে শক্তিশালী করবে।