মো: আশরাফ ইকবাল পিকলু মাজমাদার
কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি !
রোদেলার কান্নামিশ্রিত কন্ঠে কথা গুলো শুনে আকাশ ভেঙে যেন আমার মাথার উপর পড়লো। নাইনে পড়ুয়া একটা বাচ্চা ছেলে তার চরিত্রের এতটা অবনতি তা সত্যিই অবিশ্বাস্য যোগ্য।
যে ভাই টাকে এত শাসনের মাঝে রাখি সে এই জঘন্য অপরাধ কেমনে করতে পারে। তাও আবার ওর আপন ভাবির সাথে। ওকে তো আজ উচিত শিক্ষা দিয়েই ছাড়বো।আমার অগোচরে এত বড় বেয়াদব হয়েছে অথচ আমি কিছুই টের পাইনি। রোদেলা যদি না বলত তাহলে তো আরও বড় কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারতো। তার আগেই রাকিব কে কঠিন শাসনে ঠিক করতে হবে আনমনে ভেবে রোদেলার উদ্দেশ্য বললাম ”
–“রোদেলা তুমি যা বলছো সব ঠিক তো_?”
রোদেলা আমার কথায় মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সুচক জবাব দেই। ব্যস নিজের রাগ টা আর কন্ট্রোল করতে পারলাম না। রুম থেকে বের হয়ে রাকিবের রুমে গিয়ে লক্ষ্য করলাম ” টেবিলে বসে খাতায় কি যেনো লিখছে আচমকা রাগান্বিত হয়ে উচ্চ গলায় রাকিবের উদ্দেশ্যে বলে উঠি,
— ” তোর নামে এগুলা কি শুনছি ”
রাকিব হঠাৎ আমার আগমন দেখে ভয়ে থতমত খেয়ে বলে উঠে,
— ” ভাইয়া কি ব্যাপার তুমি রাগান্বিত অবস্থায় আমার রুমে কি হয়েছে _? ”
রাকিবের একথা শেষ করা মাত্রই ঠাসস, ঠাসস করে দুইগালে থাপ্পড় মেরে ও নিজেকে শান্ত রাখতে পারেনি। কাঁচা বেতঁ দিয়ে হাতে যা কুলিয়েছে তাই পিটিয়েছি ” রাগের ঘোরে মারের আঘাত এগুলো যে এতই তীব্র ছিলো যে রাকিবের হাত পিটে ফেটে র’ক্ত ঝড়ছিলো। আমি যেন ভুলেই গেছিলাম ও আমার এতিম ছোট ভাই। রাকিবের শরীরের রক্ত ঝড়তে দেখে রোদেলা আমাকে আটকে নেই। রাগের মাথায় বলে উঠি,
— ” আজ থেকে এই বেয়াদবটার খাওয়া দাওয়া একবারে বন্ধ।ওর পিছনে টাকা পয়সার না ডেলে যদি রাস্তার কোনো ছেলেকে বড় করতাম সে হইতো এতটা বেয়াদব হতো না।এই রোদেলা ওকে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলো। ওর চেহারাটা যেনো এবাসায় না দেখি ”
এই বলে নিজের রুমে চলে আসি। কিছুক্ষন পর রোদেলা আমার পাশে বসে ইমোশনাল হয়ে বলে উঠে,
— ” তোমার ছোট ভাইটাকে এভাবে মারতে পারলে।ছোট মানুষ ছিলো এক থাপ্পড় মারলেই ওর প্রাপ্য শাসন হয়ে যেতো তা না করে পুরো শরীরে র’ক্ত ঝড়িয়ে ফেললে_?”
রোদেলার প্রশ্নতে নিশ্চুপই ছিলাম তখনও রাগের ঘোর টা কাটেনি।কিছুক্ষন পর রাগটা যখন কমে গেলো তখন বুঝতে পারলাম। যে কাজ টা মোটুও ঠিক করেনি। রুম থেকে বের হয়ে জানালায় উকি দিতেই লক্ষ্য করলাম সে অবিরাম কান্না করছে আর চোখের জল হাত মুছে নিচ্ছে।
দৃশ্যটি দেখে আমার নিজের ওই খারাপ লাগা কাজ করছে।এতিম ভাইটারে এভাবে আঘাত করে মোটুও ঠিক হইনি।এতিম এই জন্যই বলছি “আমি যখন ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষের পড়তাম। মা তখন না ফিরার দেশে চলে যান।রাকিবের বয়স ২ – ৩ বছর হবে আর কি মার মৃত্যুর পর বাবাও বেশিদিন আমাদের মাঝে থাকতে পারিনি ২ বছর পর বাবাও মার মতো আমাদেরকে এতিম বানিয়ে চলে যায়।ছোট ভাইটার দায়িত্ব তখন থেকেই আমার কাঁধে । হুট করে কোনো কাজ সংগ্রহ করতে পারিনি। পরিশেষে টিউশনির করিয়ে আমার আর রাকিবের পড়াশোনা কন্টিনিউ করেছি। এভাবে অনার্স পাশ করি। তবে বেকার বেশি দিন থাকতে হইনি আল্লাহ রহমতে চাকরি ও পেয়েছি। প্রতিষ্ঠিত হবার পর রোদেলাকে বিয়ে করে সংসার জীবনে নিজেকে জড়িয়ে নেই।এইছিলো অতীত জীবন সংগ্রামের কিছু গল্প।চলুন এবার বর্তমানে ফিরা যাক।
রাকিব কান্না করছে। আর কেটে যাওয়ার ক্ষত স্থানে হাত বুলিয়ে নিচ্ছে। আড়াল থেকে ছোট ভাইয়ের কান্নাকাটি দৃশ্য দেখে নিজেরই বেশি খারাপ লাগতে শুরু করলো। রাগ মাত্রই খারাপ একটা ব্যাপার, যখন মাথায় রাগের শিহরণ জাগবে তখন শুধু তাকে আঘাত করতেই ইচ্ছা করবে আর রাগ যখন কমে যাবে তখন আনমনে অনুশোচনা মায়া কাজ করবে।
সে অনুভূতি এখন আমার হচ্ছে। অনুতপ্ত হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম। বাহিরে সারাদিন পাড় করে রাতে বাড়িতে ফিরলাম।রোদেলাকে জিজ্ঞেস করলাম ”
–“রাকিব কেমন আছে _?”
রোদেলা আমার কথা শুনে মুখ বাকিয়ে বলে উঠে,
—” আসছে ভাইয়ের দরদ দেখাতে। যখন পশুর মতো তাকে আঘাত করলো তখন একটুও দরদ উঠলো না। এখন এসে বলছে কেমন আছে? ”
রোদেলার কথা শুনে বুঝতে পারলাম। রাকিবকে এভাবে আঘাত টা সমর্থন করেনি উল্টো তার পক্ষে হয়ে আমাকে কথা শুনাছে।আনমনে ভেবে বললাম ”
–“রাকিবকে কিছু খেতে দিয়েছিলে_? “(আমি)
–“হ্যা খাবার নিয়ে ওর রুমে গিয়েছিলাম। খাবারের কথা বলা মাত্রই সমস্ত খাবার ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে” (রোদেলা)
–“নিশ্চুপ” (আমি)
এভাবেই রাত টা কেটে গেলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে রেড়ি হয়ে অফিসে যাচ্ছি। প্রতিদিনই প্রায় রাকিব আমার কাছ থেকে হাত খরচ টাকা নেই। কিন্তু আজ আর আসলো না। বুঝতে পারলাম কালকের ঘটনা জন্য আমার উপর ভিষণ ক্ষেপে আছে। রোদেলার হাতে রাকিবের পকেট খরচ দিয়ে অফিসে চলে আসি। দুইটা দিন কেটে যাওয়ার পরেও ছোট ভাইটা কোনো প্রকার কথাবার্তা বললো নাহ। আগে তো অফিসে আসার সময় হাত খরচে টাকা নিতো। স্কুলে কেমন পড়াশোনা চলছে তা নিয়ে গল্প সল্প করত কিন্তু এই দুইদিনে একদমভিন্ন হয়েছে।
বাড়িতেও কেমন জানি থমথম নিরবতা বিরাজ করছে। যে ছোট ভাইয়ের জ্বালায় বাড়িতে একটুও রোদেলার সঙ্গে গল্প সল্প করতে পারতাম না, সবসময় ফাজলামো দুষ্টমি করে আমাদেরকে হাসাতো সে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সত্যিই খুব মনের খারাপ হওয়ার বিষয়।এখন টেবিলে খেতে বসে রাকিবকে ডাকলে বলেও খেতে আসে না। রোদেলাকে দিয়ে যদি হাত খরচ পাঠিয়েতাম সে টাকাও ফিরিয়ে দিতো। বিষয়টা আমার কাছে অনেকটা খারাপ লাগতো ” রাতে আনমনে ভেবে নিলাম ” সকালে ঘুম থেকে উঠে আগে ছোট ভাইটার রাগ ভাঙাবো তারপর অফিসে যাবো এভেবে ঘুমিয়ে পড়ি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই রাকিবের রুমে উকি দিতেই দরজা খুলা দেখে ভিতরে প্রবেশ করলাম রাকিব রুমে নেই। ভাবলাম বাইরে ঘুরতে গেছে মনে হই এভেবে চলে আসতে যাবো হঠাৎ টেবিলে উপর রাখা একটা চিঠি দেখে চোখ আটকে গেলো। আগ্রহ সহিত চিঠিটা হাতে নিয়ে দুই লাইন পড়া মাত্রই পায়ের নিচে মাটি যেন সরে গেলো এবং নিজের অজান্তেই নোনা জলে চোখজোড়া ভিজে উঠলো।