এনামুল হক রাশেদী, চট্টগ্রামঃ
চট্টগ্রামবাসীর জন্য দারুন একটা গৌরব ও গর্বের দিন ৫ নভেম্ভর'২৩ ইং রবিবার। এদিন চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে উদ্বোধন করা হল চট্টগ্রামের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ১০০ বেডের ক্যান্সার হাসপাতাল। ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এমপি ফিতা কেটে হাসপাতালের উদ্বোধন করে বলেছেন, চট্টগ্রামের মানুষের জন্য আজ খুবই আনন্দের দিন। চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ক্যান্সার হাসপাতাল আজ থেকে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে। তিনি কঠিন ও বৃহৎ এই প্রকল্পের বাস্তবে রুপদান করার জন্য চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটিকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানান। এই ধরনের একটি বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তোলা খুব সহজ কাজ ছিল না। এটি সম্ভব হয়েছে এস্বপ্ন বাস্তবায়নের সাথে সংশ্লিষ্ঠ মহানুভব মানুষগুলোর আন্তরিকতা ও ঐকান্তিক প্রচেস্টার কারনেই। ক্যান্সারের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা এখন থেকে চট্টগ্রামেই হবে, এর থেকে বড় খবর, এর থেকে স্বস্তির খবর আর কিইবা হতে পারে! চট্টগ্রামবাসী মা ও শিশু হাসপাতাল নিয়ে গর্বিত।
৫ নভেম্বর'২৩ ইং রবিবার সকাল ১০ টার সময় নগরীর আগ্রাবাদস্থ চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল প্রাঙ্গনে চট্টগ্রামে প্রথম ১০০ বেডের পূর্নাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতাল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অথিতি হিসাবে উপস্থিত থেকে হাসপাতালের উদ্বোধন করেন চট্টগ্রামের গর্বিত কৃতি সন্তান মাননীয় ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এমপি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান, একুশে পদকপ্রাপ্ত দৈনিক আজাদী সম্পাদক লায়ন এম এ মালেক। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য এম এ লতিফ, সংসদ সদস্য মো. মহিউদ্দিন বাচ্চু ও জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির মেম্বার সেক্রেটারি ও হাসপাতালের কার্যনির্বাহী কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি মোহাম্মদ রেজাউল করিম আজাদ।
ভূমিমন্ত্রী হাসপাতালের চিকিৎসকদের উদ্দেশে বলেন, এখানে যেন ক্যান্সারের সব চিকিৎসা হয়। চিকিৎসার জন্য যেন মানুষকে এখান থেকে বাইরে অন্য কোথাও যেতে না হয়। এখানে মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত করা গেলে দেশের মানুষ আর চিকিৎসার জন্য বাইরে ছুটবে না। করোনাকালের ভয়াবহতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, তখন দেশেই চিকিৎসা হয়েছে। এই মা ও শিশু হাসপাতালও চিকিৎসা ক্ষেত্রে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে। সামনের দিনগুলোতেও মা ও শিশু হাসপাতালের ক্যান্সার রিচার্স সেন্টার অনন্য ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। মাত্র দুই বছরের মধ্যে এই ক্যান্সার হাসপাতালের কাজ সম্পন্ন করে চিকিৎসাসেবা শুরু করতে পারায় তিনি কতৃপক্ষকে ধন্যবাদ দেওয়ার পাশাপাশি পরম করুনাময়ের দরবারে শোকরিয়া আদায় করে বলেন, এ হাসপাতাল বাস্তবায়নে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ যে যতটুকু পেরেছেন সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের এই দান সদকায়ে জারিয়া হিসেবে আল্লাহ কবুল করবেন। এমন মহৎ একটি কাজে তিনি নিজেকে যুক্ত করতে পেরে পরম করুণাময়ের শোকরিয়া আদায় করেন এবং নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করছেন বলেও জানান।
দেশের বাইরে অনেক প্রবাসী ভাই–বোন আছেন যারা অনকোলজি বিশেষজ্ঞ। তারা যদি মাঝে মাঝে এসে এখানে রোগীদের সময় দেন এবং পরামর্শ প্রদান করেন তাহলে হাসপাতালের চিকিৎসার মান ও সুনাম বৃদ্ধি পাবে উল্লেখ করে মাননীয় মন্ত্রী বলেন, এখানে রোগীদের স্বল্পব্যয়ে চিকিৎসাসেবার মান নিশ্চিত করতে হবে। কারণ যাদের পয়সা অনেক তারা চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে পারে। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে যারা একটু পিছিয়ে তারা যেন পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা এখান থেকে পায় সেই বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। সেবার মান উন্নত হলে ধনীরাও এখানে চিকিৎসারর জন্য আসবেন বলে মনে করেন তিনি। মন্ত্রী আরো বলেন, বর্তমান সরকারের বদৌলতে চট্টগ্রাম সব দিক দিয়ে এগিয়ে। এখানে কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন করা হয়েছে, যা দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় প্রথম। ফ্লাইওভারের কাজও শেষ পর্যায়ে। আবার ক্যান্সার হসপিটাল ও রিসার্চ সেন্টার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে চিকিৎসাসেবার দিক দিয়েও আরো একধাপ এগিয়ে গেল চট্টগ্রাম।
প্রয়াত সৈয়দ মোহাম্মদ নুরুদ্দিনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, তার মতো দানবীর সমাজে বিরল। তিনিই প্রথম এই ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়নের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। দেশবরেণ্য ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ প্রফেসর কামরুজ্জামান চৌধুরীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান এজন্য যে, তিনি চট্টগ্রামের রোগীদের জন্য এই হাসপাতালে সপ্তাহে দুদিন চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য সম্মত হয়েছেন।হাসপাতালের সাথে তিনি শুরু থেকেই ছিলেন ভবিষ্যতেও সার্বিক সহযোগিতা সহ সাথো থাকবে বলে জানান। হাসপাতালের পাশের কিছু সরকারি জায়গা যাতে অবিলম্বে হাসপাতালের নামে করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় সে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তিনি জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা প্রদান করেন।
অনুষ্ঠানের সভাপতি এবং ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান এম এ মালেক বলেন, ক্যান্সার শব্দটি শুরু হয়েছে ক্যান দিয়ে। মানে ‘পারি’। আমরা অসুস্থ, অসহায় মানুষকে সুস্থ করতে পারি, তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি। এজন্য চাই আত্মবিশ্বাস। এই আত্মবিশ্বাস থেকেই শুরু হয়েছে আজকের এই ক্যান্সার হাসপাতাল। এখান থেকে নতুন জীবনের স্বপ্ন বুনতে শুরু করবেন ক্যান্সার আক্রান্তরা।ক্যান্সার আক্রান্ত এক ব্রিটিশ সাংবাদিকের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ক্যান্সার একটি শব্দ, বাক্য নয়। সেনটেন্সের পরে ফুলস্টপ দিতে হয়। কিন্তু শব্দের পর শব্দ বসিয়ে স্বপ্ন রচনা করা যায়; যে কোনো কঠিন, কঠোর পরিস্থিতিতে নতুন করে শুরু করার স্বপ্ন। মা ও শিশু হাসপাতালে পূর্নাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতাল উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আরো একটি মাইলফলক স্থাপিত হলো বলে উল্লেখ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে ক্যান্সার হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা ও কার্যক্রম নিয়ে মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশন করেন অনকোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও পরিচালক, সহযোগী অধ্যাপক ডা. শেফাতুজ্জাহান। বক্তব্য দেন হাসপাতালের কার্যনির্বাহী কমিটির প্রেসিডেন্ট (ভারপ্রাপ্ত) সৈয়দ মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন, ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির কো–চেয়ারম্যান এস এম আবু তৈয়ব, ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের চিফ অ্যাডভাইজার ও সিনিয়র কনসালটেন্ট প্রফেসর ডা. কামরুজ্জামান চৌধুরী, হাসপাতালের মেগা ডোনার মরহুম সৈয়দ মোহাম্মদ নুরুদ্দিনের মেয়ে আনিকা হুমায়রা প্রমুখঃ।
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন, লায়ন জেলা গভর্নর এমডিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, রোটারী জেলা গভর্নর ইলেক্ট ডা. মইনুল ইসলাম মাহমুদ, হাসপাতালের কার্যনির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল মান্নান রানা, ইঞ্জিনিয়ার জাবেদ আবছার চৌধুরী, ডা. পারভেজ ইকবাল শরীফ, জয়েন্ট জেনারেল সেক্রেটারি (ডোনার) সৈয়দ আজিজ নাজিমউদ্দীন, ট্রেজারার অধ্যক্ষ ড. লায়ন মোহাম্মদ সানাউল্লাহ, জয়েন্ট ট্রেজারার লায়ন এস এম কুতুব উদ্দিন, অর্গানাইজিং সেক্রেটারি মোহাম্মদ সাগির, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য প্রফেসর ডা. কামরুন নেসা রুনা, মো. আলমগীর পারভেজ, প্রফেসর ডা. জাহিদ হোসেন শরীফ, ডা. ফজল করিম বাবুল, মো. হারুন ইউসুফ, এ এস এম জাফর, চমাশিহা মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল প্রফেসর এ এস এম মোস্তাক আহমেদ, পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. নূরুল হক, ভাইস প্রিন্সিপাল প্রফেসর ডা. অসীম কুমার বড়ুয়া, উপপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন, উপপরিচালক (মেডিকেল অ্যাফেয়ার্স) ডা. এ কে এম আশরাফুল করিম এবং হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের অধ্যাপকবৃন্দ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. ফাহিম হাসান রেজা ও এএমইউ বিভাগের রেজিষ্ট্রার ডা. ইফফাত চৌধুরী।
মা ও শিশু হাসপাতালের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান চমশিহা ক্যান্সার ইনস্টিটিউট অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে ১০০ বেড ছাড়াও আউটডোরে বিপুল সংখ্যক রোগীকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করার সক্ষমতা রয়েছে। রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি দেওয়া যাবে দৈনিক ৭০ থেকে ৮০ জন রোগীকে। দেশের সর্বাধুনিক লিনিয়ার এক্সিলেরাটর মেশিনসহ ক্যান্সার চিকিৎসার আধুনিক সব যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে এই হাসপাতালে। রোগীদের জন্য এখানে সর্বাধুনিক সুযোগ–সুবিধাসহ আইসিইউ, কেবিন, সাধারণ শয্যাসহ ১১ তলা ভবনে মোট ১০০ শয্যার ব্যবস্থা থাকবে। পাশের জায়গাটি পাওয়ার পর সেখানে ডরমেটরি নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির মেম্বার সেক্রেটারি রেজাউল করিম আজাদ।