মো: আশরাফ ইকবাল পিকলু মাজমাদার
কুষ্টিয়া জলা প্রতিনিধি !!
বাবা কি মনে করে যেন কথার জবাব না দিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। মা যেদিন আমার টিউশনি মাষ্টার মোতালেব স্যারের সাথে পালিয়ে গেছে সেদিনও বাবা কাঁদেনি। জীবনে প্রথম বার কাঁদতে দেখে নিরীহ, নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলাম।বলতে খুব ইচ্ছে করেছিল, ‘বাবা কাঁদবেন না। এই তো দেখো, মাকে ছাড়া ও তোমার এই ছেলেটা বেশ ভালো আছে।'
মোতালেব মাষ্টার আমাকে সপ্তাহে তিন দিন পড়াতো। বিমলতা হাউজ নামক যে বাড়িতে ভাড়া থাকি, সে বাড়ির মালিক সামসু মিয়া আমাকে পড়ানোর জন্য ঠিক করে দিয়েছিল। সপ্তাহে তিন দিন পড়িয়ে মাসে দুই হাজার টাকা নিতো। বাবার অল্প বেতনের চাকুরি, নারায়ণগঞ্জের সুতার দোকানে চাকুরি করে যে টাকা বেতন পেতো তা দিয়ে সংসার চালানোর পর এই দুই হাজার টাকাই বাড়তি থাকতো।
বাড়তি টাকাটা দিয়ে একটা ডিপজিট খুলেছিলেন। মায়ের কাছে শুনেছিলাম বাবার খুব ইচ্ছে আমাকে মেডিকেলে পড়াবেন। পাশের বাড়ির কাশেম চেয়ারম্যানের ছেলেটা মেডিকেলে পড়ে, ওনার কাছ থেকে শুনেছেন পড়াতে অনেক টাকা লাগে। হঠাৎ করে এতো টাকা কোথায় পাবেন, এটা ভেবেই দুই হাজার টাকা করে জমিয়ে রাখেন।
মোতালেব মাষ্টারের সাথে মা পালিয়ে গেছে এই খবরটা শুনলাম বিকেলের দিকে। ঠিক কয়টা বাজে বলতে পারবো না। সবে মাত্র প্রথম শ্রেণীতে পড়ি, ঘড়ি দেখে সময় বের করার হিসেবটা তখনো পুরোপুরি শিখি নাই। বাবা নারায়ণগঞ্জের সুতার দোকান থেকে প্রতি শুক্রবারে আসে। হঠাৎ করে সেদিন বাড়িতে আসায় আমার আনন্দের সীমা রইলো না। এর আগের সপ্তাহে বলে গিয়েছিল আমার জন্য ঘড়ি কিনে আনবে, কাটা ওয়ালা ঘড়ি দেখে সময় বুঝতে পারি না বলে ডিজিটাল ঘড়ি কিনে আনবেন।
'
'
'
তারপর মাকে ছাড়াই আমার কেটে গেছে একুশ বছর ছয় মাস পনেরো দিন। প্রতিটা দিন বাবার মতো করে এখনো আমি ও হিসেব করে রাখি। হিসেবের এই কঠিন দিনগুলোতে ও বাবার স্বপ্নটা পূরণ করতে ছুটে বেড়াচ্ছি। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করার দুই বছরের মধ্যেই নিজ উপজেলা সাস্থ কমপ্লেক্সে চাকুরি হয়েছে। বাবা ও ছেলে দু'জনে পুরোনো বাসায় এক সাথেই থাকি। এতো বছর পরে ও বৃষ্টির দিনে যখনি দরজায় কোন শব্দ হয় বাবা পাগলের মতো ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। মাকে দেখতে না পেয়ে ড্রয়ারে খুব যত্ন করে রেখে দেওয়া মায়ের শাড়িটা হাতে নিয়ে বসে থাকেন।
মা কোন একদিন নিজের ভুল বুজতে পেরে ফিরে আসবে। এই ভুলটা নিয়ে বাবা বেঁচে আছে দেখে নিজের কাছে প্রায় সময় খুব রাগ হয়। তবু ও বাবাকে কঠিন গলায় কিছুই বলতে পারি না। দাদীর কাছে শুনেছি, মাকে ভীষণ ভালবেসে বাবা বিয়ে করেছে। মায়ের প্রতি বাবার প্রচণ্ড ভালবাসা আর বিশ্বাস দেখে দাদী নিজে ও ভালবাসাটা মেনে নিয়ে নিজেই আগ্রহ দেখিয়ে দাদাকে বুঝিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করেন।
'
'
চেম্বার থেকে রোগী দেখে ফেরার পথে দশটা বেজে গেছে। দোকান খোলা পাওয়া নিয়ে টেনশন হচ্ছিল। খোলা পেয়েই বাবার জন্য আজকে একটা ঘড়ি নিয়েছি। দোকান থেকে বের হয়ে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে ভাবছি, ঘড়ির কাটায় ঘুরতে থাকা এই সময়টা খুবই রহস্যময়। বাবার মতো অতিরিক্ত ভালবাসার মায়াজালে আটকে থাকা মানুষদের এমনভাবে অপেক্ষা করাতে শিখায়, কখন যে পুরো এক জীবন কেটে যায় বুঝতেই পারে না।
.
(সমাপ্ত)
--------------------